'ম্যাংগো স্পেশাল' ট্রেন, ৭ দিনে লোকসান ৭০ লাখ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী হয়ে ঢাকা রুটে চলা ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ ট্রেন এবারও আম ব্যবসায়ীদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি। চাষি ও ব্যবসায়ীদের আম সহজে ঢাকায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিবছর আমের মৌসুমে ট্রেনটি চলাচল করলেও বাস্তবে কোনো কাজে আসে না; বরং এই ট্রেন চালাতে গিয়ে প্রতিবছর মোটা হচ্ছে রেলওয়ের লোকসানের খাতা। আম না পেয়ে চলতি মৌসুমে মাত্র সাত দিন চলেছে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন। এই কয় দিন অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা চলেছে ট্রেন। আর এই সেবা সচল রাখতে গিয়ে মাত্র এক সপ্তাহে রেল বিভাগের লোকসান হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা।

শুরু থেকেই নানা অভিযোগ ও সমালোচনার পরও ট্রেনটি চালু রাখার ঘোষণা দেয় রেল বিভাগ। কিন্তু আম ব্যবসায়ীরা এবারও ট্রেনে আগ্রহী হননি। মূলত স্টেশন পর্যন্ত আম পৌঁছানোর পর সেগুলো গন্তব্যে পৌঁছানো অনেক ঝামেলা। এই যুক্তিতেই এখনো আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা কুরিয়ার সার্ভিসনির্ভর।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনে আম পরিবহন হয়েছে ১৮ হাজার ১৪৬ কেজি। এতে রেলের আয় হয়েছে ২৭ হাজার ৩৪৫ টাকা। ঈদুল আজহা উপলক্ষে একই ট্রেনে দুদিনে পশু পরিবহন করা হয় ১০৫টি। এতে রেলের আয় হয়েছে ৯২ হাজার ৮২০ টাকা; অর্থাৎ এক সপ্তাহে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনে আম ও গরু পরিবহন করে আয় হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ১৬৫ টাকা।

এ বছর ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাওয়া-আসা করে। এতে দৈনিক খরচ হয়েছে ১০ লাখ ২৩ হাজার ৮৪০ টাকা। সেই হিসাবে সাত দিনে ট্রেনটি পরিচালনায় খরচ হয়েছে ৭১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮০ টাকা; অর্থাৎ এই কয়দিনে রেলের লোকসান হয়েছে ৭০ লাখ ৪৬ হাজার ৭১৫ টাকা।

পশ্চিমাঞ্চল রেলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চালুর প্রথম বছর ২০২০ সালে ৪৭ দিনে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন আম পরিবহন করে ১১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯ কেজি। এতে আয় হয় ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫৩৬ টাকা, ব্যয় হয় ৫৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২০২১ সালে ৪৯ দিনে ট্রেনটি আম পরিবহন করে ২২ লাখ ৯৯ হাজার ৯২০ কেজি। এতে আয় হয় ২৬ লাখ ৩০ হাজার ৯২৮ টাকা, ব্যয় হয় ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০২২ সালে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন আম পরিবহন করে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৭৮ কেজি। এতে আয় হয় ২ লাখ ১২ হাজার ১৭৪ টাকা আর ব্যয় হয় ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন ১৮ দিনে আম পরিবহন করে ১২ লাখ ৭ হাজার কেজি। এতে আয় হয় ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৫০২ টাকা, আর ব্যয় হয় ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা; অর্থাৎ চার বছরে ট্রেন থেকে রেল আয় করেছে ৪৬ লাখ ৩৯ হাজার ১৪০ টাকা। বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ ২২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে রেলের লোকসান ১ কোটি ৮২ হাজার ৮৬০ টাকা। এ বছর নতুন করে লোকসান যোগ হয়েছে আরও ৭০ লাখ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেল কর্র্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতির কারণে এই সেবা খাতটিকে প্রতিবছরই লোকসান গুনতে হচ্ছে। বড় সমস্যা হিসেবে তারা আম পাঠানো ও গ্রহণের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করছেন।

রাজশাহীর বাঘার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সাদিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রতিবছর দেশের বাইরে আম রপ্তানি করেন। সে কারণে আমের মান ভালো রাখতে হয়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিতভাবে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ট্রেনে শীতাতপনিয়ন্ত্রিতভাবে আম পাঠানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া রাজশাহী থেকে সরাসরি সিলেট ও চট্টগ্রামে আম পরিবহনের সুযোগ নেই। ফলে ট্রেনের চেয়ে কুরিয়ারেই ব্যবসায়ীরা ভরসা করেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষি মতিউল ইসলাম বলেন, বাগান থেকে সরাসরি আম ট্রাকে করে ঢাকায় যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ট্রেনে আম নেওয়ার জন্য স্টেশনে যেতে হয়। সেখান থেকে আবার আড়তে নিতে হয়। আবার যাত্রার শুরুতেও স্টেশনে গিয়ে আম দিয়ে আসতে হয়। এতে ওঠানো-নামানোসহ পরিবহন খরচ বেশি পড়ে যায়। এ ছাড়া স্টেশনে রোদে ও বৃষ্টিতে আম ফেলে রাখা হয়। প্রতিটি স্টেশনে আম রাখার সুব্যবস্থা থাকলে ও ঢাকায় হোম ডেলিভারি চালু করা গেলে চাষিদের ট্রেনে পরিবহনে আগ্রহ বাড়তে পারে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক আহম্মদ হোসেন মাসুম বলেন, রেলের লোকসানের কারণ হচ্ছে লোকজন আমাদের মাধ্যমে আম নেয়নি। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখেনি। তারা ভেবেছে সড়কপথে সহজে নিয়ে যাবে। যখন কারও কিছুর একটা অভ্যাস হয়ে যায়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে যায়, এটাই মূল কারণ।

সংবাদসূত্র: দেশরূপান্তর।।